যিনি দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রেমে বিলীন ছিলেন — জীবনভর জিকিরে জেগে থাকা এক আল্লাহওয়ালা দরবেশ।
জন্ম ও শৈশব
ওলিয়ে কামিল হযরত শাহ আজম (রহ.) ১৮৯৬ সালে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুগাছ ইউনিয়নের রামপাশা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ও ধর্মপরায়ণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন শেখ মোহাম্মদ ধনাই মিয়া এবং মাতা হালিমা বিবি।
শৈশবে তিনি পারিবারিক মক্তবে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। পরবর্তীতে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন এবং আত্মপ্রচেষ্টায় উচ্চতর শিক্ষায়ও মনোনিবেশ করেন। কৈশোর থেকেই আল্লাহভীতি, মানবসেবা ও তরিকতের প্রতি অনুরাগ তাঁর জীবনে দিকনির্দেশনা দেয়।
দুনিয়ার মোহ ত্যাগ করে মাওলার পথে
হযরত শাহ আজম (রহ.) দুনিয়াবি চাকরি বা অর্থকড়িকে জীবনের উদ্দেশ্য মনে করেননি। তাঁর হৃদয় ছিল আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর প্রেমে পরিপূর্ণ। মানুষের কল্যাণ ও দ্বীনের সেবা ছিল তাঁর জীবনের একমাত্র সাধনা। ১৯২৯ সালে মাত্র ৩৩ বছর বয়সে সংসারজীবন ত্যাগ করে তিনি সম্পূর্ণভাবে আল্লাহমুখী জীবনে প্রবেশ করেন। পরবর্তী ৫০ বছর তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করে দ্বীনের দাওয়াত ও তাসাউফ প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
দ্বীনি খেদমত ও মানবসেবা
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হযরত শাহ আজম (রহ.) সারা জীবন মানুষকে সৎপথে আহ্বান করেছেন। তিনি বিভিন্ন স্থানে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব ও খানকাহ প্রতিষ্ঠা করেন; রাস্তাঘাট, পুল ও কালভার্ট নির্মাণেও উদ্যোগ নেন।
কমলগঞ্জ উপজেলার ভানুবিল গ্রামের কাঁচা রাস্তা নিজ উদ্যোগে সংস্কার করে তিনি সেটিকে চলাচলযোগ্য করেন। কৃতজ্ঞ এলাকাবাসী রাস্তার নাম রাখেন “ভানুবিল হযরত শাহ আজম (রহ.) রোড”।
মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুর ইউনিয়নের গয়গড় গ্রামে অবস্থিত ঐতিহাসিক খোজার মসজিদ তাঁরই উদ্যোগে পুনর্নির্মিত হয়। শতবর্ষ প্রাচীন ও ধ্বংসাবশেষে ঢাকা এ মসজিদটি তিনি উদ্ধার করেন ও পাশে একটি পুকুর খনন করেন, যা বর্তমানে “ওলিয়ে কামিল পুকুর” নামে পরিচিত।
খালিশপুর গ্রামে আড়াই কেদার জমির ওপর তিনি খানকাহ শরীফ ও গদ্দীবাড়ী প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে আজও প্রতি বৃহস্পতিবার জিকির-আজকার ও খাস দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এই খানকাহ ও এর জমি তিনি মহান পীর হযরত আবদুল কাদির জিলানী (রহ.)-এর নামে ওয়াকফ করেন।
এছাড়া সরাপুর, গোড়াখাল, কাঠালকান্দি ও ভানুবিলসহ বিভিন্ন গ্রামে তিনি ফুরকানিয়া মক্তব, ওজুর জন্য পুকুর, রাস্তা ও কবরস্থান সংস্কারসহ অসংখ্য সাদাকাহে জারিয়া-মূলক কাজ করেন।
আধ্যাত্মিক পথ ও পীর-মুর্শিদ সম্পর্ক
তাঁর আধ্যাত্মিক শিক্ষক ছিলেন ভারতের কৈলাশহরের বিশিষ্ট সাধক ও কবি হযরত মাওলানা শাহ ইয়াসিন (রহ.)। তিনি তাঁরই নিকট বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং তরিকায়ে কাদেরিয়ার শিক্ষা ও আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভ করেন। হযরত ইয়াসিন (রহ.) ছিলেন একজন মরমী কবি ও গবেষক, যিনি কুরআন ও হাদীসের আলোকে শতাধিক আধ্যাত্মিক কবিতা রচনা করেছেন। তিনি শাহ আজম (রহ.)-কেই একমাত্র খলিফা হিসেবে মনোনীত করেন।
তাঁর দাদা ছিলেন নোয়াখালীর নন্দনপুরের ওলিয়ে কামিল হযরত মাওলানা শাহ খলিলুর রহমান নন্দনপুরী (রহ.)। দাদার নামানুসারে তিনি খালিশপুরে “দারায়ে খলিলিয়া” নামে একটি জিকির ও মাহফিল ঘর নির্মাণ করেন।
জিকিরে জেগে থাকা সাধক
হযরত শাহ আজম (রহ.) ছিলেন এক গভীর জিকিরমগ্ন সাধক। তাঁর ভক্তরা বর্ণনা করেন—জিকিরে মগ্ন হয়ে তিনি প্রায়ই ঘন্টার পর ঘন্টা স্তব্ধ থাকতেন, যেন আল্লাহর সান্নিধ্যে বিলীন হয়ে গেছেন। তাঁর জবান থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে উচ্চারিত হতো— “আল্লাহ... আল্লাহ... লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ... মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।”
তিনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি গভীর প্রেম পোষণ করতেন। দুনিয়ার কোনো মোহ বা সম্পদ তাঁকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ছিল আল্লাহ ও রাসুলের সন্তুষ্টি অর্জনের সংগ্রাম।
উত্তরাধিকার ও দারগাহ শরীফ
তাঁর দুই পুত্র—মোহাম্মদ আছরব উল্লাহ ও মাওলানা শাহ মোহাম্মদ মোশাররফ আলী—এবং এক কন্যা আছতরী বিবি ছিলেন। বর্তমানে তাঁরা কেউ জীবিত নন।
হযরত শাহ আজম (রহ.)-এর পবিত্র মাজার শরীফ মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের রামপাশা আংশিক গ্রামে অবস্থিত। এখানে প্রতিষ্ঠিত হযরত শাহ আজম (রহ.) দরগাহ জামে মসজিদ, হিফজুল কুরআন দরগাহ মডেল মাদ্রাসা ও হযরত হাসান আলী হাফিজি মাদ্রাসা তাঁর নামেই পরিচালিত হচ্ছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সাদাকাহে জারিয়াগুলো দেশ-বিদেশের আশেকান ও দাতাদের সহায়তায় আজও দ্বীনি সেবা চালিয়ে যাচ্ছে।
পরিসমাপ্তি
১৩৮৬ বঙ্গাব্দের ২৯ শ্রাবণ (রমজান মাসে) এই মহান ওলি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়ার সফর শেষ করেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় জিকির, ইবাদত ও মানবসেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
