বাংলা সাহিত্যে "স্বভাবজাত" শব্দটি এমন মানুষের জন্যই ব্যবহৃত হয়, যিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজের মেধা, চিন্তা ও অনুভূতিকে তাৎক্ষণিকভাবে শব্দে রূপ দিতে পারেন—কখনো কবিতায়, কখনো গজলে, কখনো গানে। এই ক্ষমতা জন্মগত। শব্দের সাথে খেলা, ছন্দের মায়াজাল গড়া, সুরে ঢেলে দেওয়া—সবই যেন তাঁর অন্তর্গত প্রতিভার স্বাভাবিক প্রকাশ।
এমনই এক বহুমাত্রিক প্রতিভার নাম কবি মুজাহিদুল ইসলাম বুলবুল—যিনি কবি, গীতিকার, সুরকার ও গায়ক—সব ভূমিকাতেই সমান দক্ষ। বাংলা সাহিত্যে সব্যসাচী বলে যে অভিধা আছে, সেটি তাঁর নামের সাথেই অনায়াসে জুড়ে যায়।
২৫ বছরেরও বেশি সৃজনযাত্রা: গত আড়াই দশকেরও বেশি সময় ধরে মুজাহিদ বুলবুল বাংলা সাহিত্য ও ইসলামী সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দীপ্ত উপস্থিতি রেখেছেন। বিশেষত ইসলামী সঙ্গীতে হামদ-নাত, শানে আউলিয়া, দেশাত্মবোধক, সমসাময়িক ইস্যু, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও দুর্যোগ বিষয়ক সৃষ্টিতে তাঁর মতো বহুমুখী শিল্পী বিরল। দেশ-বিদেশের বহু গুণী গীতিকার ও শিল্পীর কাজ চোখে পড়লেও, লেখা ও গাওয়ার বিস্তৃত সীমানায় মুজাহিদ বুলবুল যেভাবে বিচরণ করেছেন, তা অন্য কারও ক্ষেত্রে বিরল।
যে বিষয়গুলোতে তিনি অনন্য: হামদ-নাত ও শানে আউলিয়ায় তিনি অপ্রতিরোধ্য। পাশাপাশি লিখেছেন ও গেয়েছেন এমনসব বিষয় নিয়ে, যা অনেকে কল্পনাও করতে পারবেন না—
ভাস্কর্যবিরোধী সঙ্গীত
করোনা কালে চিকিৎসক-নার্সদের প্রতি শ্রদ্ধা ও অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান
ধর্ষণ ও সন্ত্রাসবিরোধী গান
রাজনৈতিক নেতাপূজারি কর্মীবিরোধী ব্যঙ্গগান
ত্রাণ চোরদের বিরুদ্ধে ‘থাপ্পড় সঙ্গীত’
নাস্তিকতা বিরোধী গজল
নোংরা রাজনীতির সমালোচনা
“রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চাই” গজল
জাতীয় ঐক্যবিষয়ক গান
ভণ্ড প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ‘ভোট চাই’ গান
জনপ্রিয় গজল “লক্বব নেশা”
ওয়াজের নামে বাউল গান আয়োজনের সমালোচনা
ভণ্ড ওয়াইজদের পৃষ্ঠপোষক কমিটিকে নিয়ে গজল
২০১৮ সালের “নিরাপদ সড়ক চাই” আন্দোলনের গজল
কাশ্মীর, রোহিঙ্গা ও প্রথম কিবলার দেশ বিষয়ে আবেগময় সৃষ্টিকর্ম
পাহাড়ে আজান বন্ধের ঘটনায় লেখা “আজান হবে” গান
বিতর্কিত শিক্ষানীতি বিরোধী সঙ্গীত
আন্তর্জাতিক ইস্যুতে “Shame India” ও “তেরা-মেরা রিশতা কিয়া” গান
বঙ্গবন্ধু সমীপে স্বৈরাচারবিরোধী গান—যার প্রতিটি শব্দ ছিল পতিত শাসকের গালে একেকটি চপেটাঘাত
এছাড়াও অসংখ্য জাগরণী ও প্রতিবাদী সঙ্গীতের রচয়িতা তিনি, যার অধিকাংশই গত ১৬ বছরের স্বৈরশাসনকালেই লেখা ও পরিবেশিত।
প্রতিবাদে আপসহীন কণ্ঠ: মুজাহিদ বুলবুল কখনো কারও মুখাপেক্ষী হয়ে লেখেন না। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কলম ও কণ্ঠকে ব্যবহার করে আসছেন নির্ভয়ে। তবুও সাম্প্রতিক সময়ে, কিছু রাজনৈতিক পক্ষের সমালোচনা করায় তিনি ব্যক্তিগত আক্রমণ ও কুৎসার শিকার হচ্ছেন। বিদ্রূপের বিষয়—যারা আজ তাঁর প্রতিবাদী সত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তারাই একসময় ক্ষমতাবানদের দরবারে গান গাইতে গেছেন, অথচ সেই সময়ে মুজাহিদ বুলবুল ছিলেন রাস্তায়, মঞ্চে, কলমে—জনতার কণ্ঠস্বর হয়ে।
সীমার বাইরে অবদান: ইসলামী ঐক্যের পক্ষে তিনি প্রায় প্রতিবছর গান লিখেছেন, গেয়েছেন এবং ভিন্ন ঘরানার শিল্পীদেরও পেশাগত টিকে থাকার সুযোগ করে দিয়েছেন। অথচ সেই উপকারভোগীদের কেউ কেউ আজ নিমকহারামির মতো তাঁর সমালোচনায় মুখর।
এক ও অদ্বিতীয়: মুজাহিদ বুলবুলের নিজস্ব এক পরিচিতি আছে—তিনি কারও ছায়ায় দাঁড়ান না, আবার সবার পক্ষে দাঁড়াতে ভয় পান না। হাল আমলে তাঁর সমতুল্য শিল্পী নেই, এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও হবে না। সুরের সম্রাট, রাষ্ট্রচিন্তক কিংবা বিপুল প্যাকেজের শিল্পী অনেকেই জন্মাবেন, কিন্তু দ্বিতীয় মুজাহিদ বুলবুল আর জন্মাবে না।