জুবায়ের আহমদ, ঢাকা থেকে ফিরে
গত ৬ মে ছিল ইতিহাসের এক গৌরবোজ্জ্বল দিন—উপমহাদেশের আযাদী আন্দোলনের মহানায়ক, সাহস ও ত্যাগের প্রতীক আমীরুল মোমিনিন সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.)-এর স্মরণে ঢাকায় পালিত হয় বালাকোট দিবস। ঢাকার বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে আয়োজিত সম্মেলনে অংশ নিতে জকিগঞ্জ উপজেলা থেকে চারটি বাসযোগে প্রায় ১৮০ জনের বিশাল কাফেলা ৫ মে রাতে রওনা হয় রাজধানীর পথে।
এই কাফেলা কেবল একটি সফর ছিল না—এ ছিল একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা, একত্রে পথচলার সৌহার্দ্য, স্মৃতির ভান্ডার আর আত্মার খোরাক খুঁজে পাওয়ার অভিজ্ঞতা।
রাতভর যাত্রা, প্রিয় মুখের সাহচর্যে
যাত্রা শুরু হয় চিরচেনা জকিগঞ্জ থেকে। সহযাত্রীদের মধ্যে ছিলেন সোনাপুর মাজহারুল উলূম আলিম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা কুতবুল আলম, জকিগঞ্জ উপজেলা প্রেসক্লাবের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মুকিত, তথ্যপ্রযুক্তি সম্পাদক আহমদ আল মঞ্জুর, জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী আহমদুল হক, হাফিজ আলী হোসেনসহ অনেক প্রিয় মুখ। বাসের প্রতিটি আসনে ছিলো আলাপ, আশাবাদ আর সম্মেলন ঘিরে আগ্রহের উত্তেজনা।
রাজধানীর সকালে পায়ে হেঁটে বায়তুল মোকাররম
সকালে যখন আমরা ঢাকার সায়দাবাদে পৌঁছাই, তখন বাসচালক জানালেন শহরের ভেতরে দিনে বাস যাওয়া সম্ভব নয়। ফলে সবাই পায়ে হেঁটে বায়তুল মোকাররমের দিকে রওনা দিলাম। রাস্তার ধুলা-মাঠি যেন আমাদের অগ্রজ শহীদদের কষ্টের স্মারক হয়ে উঠলো।
এদিকে সম্মেলন শুরু হয়নি। মাওলানা কুতবুল আলম জানালেন, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড ও অধিদপ্তরে তাঁর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। আমি তাঁর সঙ্গী হয়ে গেলাম। রিকশায় চেপে পৌঁছে গেলাম শিক্ষা বোর্ডে। কাজ সেরে ক্যান্টিনে সকালের নাস্তা করে রওনা হলাম অধিদপ্তরের দিকে। অফিসিয়াল কাজ শেষে দুপুর ১টার দিকে আমরা আবার মিলনায়তনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি।
সম্মেলনের প্রাণময়তা ও দরবারগুলোর ঐক্যের আহ্বান
জোহরের নামাজ আদায় করে বালাকোট সম্মেলনে যোগ দিই। মিলনায়তন কানায় কানায় পূর্ণ, ফলে আমরা বাইরে বসি প্রজেক্টরের সামনে। তারপর একে একে শুরু হয় দেশের খ্যাতিমান দরবারগুলোর পীর-মাশায়েখদের বক্তৃতা—ফুলতলী, ছারছীনা, দারুল আমান, সোনাকান্দা সহ আরও অনেকে। তাঁদের কণ্ঠে ঐক্যের আহ্বান যেন আকাশ-বাতাস ভেদ করে হৃদয়ে নেমে আসে। সেদিনের সেই মুহূর্তগুলো আজও কানে বাজে।উদ্যোমী হাফিজ ফারুকের আতিথেয়তায় এক চমৎকার দুপুর
সম্মেলনের একাংশ উপভোগের পর আমরা চারজন (আমি, মাওলানা কুতবুল আলম, আব্দুল মুকিত ও মিজান) যাই ফকিরাপুলে, মেসার্স সালাম ট্রাভেলস অফিসে। সেখানে স্বাগতম জানান এলাকার উদ্যমী তরুণ হাফিজ ফারুক আহমদ। তাঁর পরিপাটি অফিস আর আন্তরিকতায় মন ভরে যায়। আরও চমক ছিল—সেখানে আমাদের পুরনো বন্ধু, জকিগঞ্জ উপজেলা তালামীযের সাবেক সভাপতি এহসান মোহাম্মদ শামীমও ছিলেন। মধ্যাহ্নভোজে ছিলো আতিথেয়তার ঔজ্জ্বল্য।সাংবাদিকদের সাথে হৃদ্যতা ও প্রেরণা
এরপর আমরা যাই জাতীয় প্রেসক্লাবে। উদ্দেশ্য—সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ এবং জকিগঞ্জ উপজেলা প্রেসক্লাবের উন্নয়ন পরিকল্পনা। বেশ কিছু সময়ের সংলাপে উঠে আসে দিকনির্দেশনামূলক অনেক কথা। পরে যাই দৈনিক ভোরের ডাকের প্রধান কার্যালয়ে। সম্পাদক কে.এম বেলায়েত হোসাইন আমাদের সঙ্গে সময় দেন আন্তরিকভাবে, শোনান তাঁর জীবনের মূল্যবান অভিজ্ঞতা—যা আমাদের আগামী পথচলায় আলোর দিশা হয়ে থাকবে।রাতের পথে অপ্রীতিকর ঘটনার সাময়িক ছায়া
রাত ৯টায় সিলেটের উদ্দেশ্যে আবার যাত্রা শুরু। ঢাকার বাইরে গিয়ে নারায়ণগঞ্জ এলাকায় হঠাৎ বাসচালক কিছু অপরিচিত যাত্রী তুলতে চান। আমাদের প্রতিবাদে তারা নামলেও, চালক ও স্টাফদের আচরণে উদ্বেগ জন্ম নেয়। সঙ্গে থাকা বাকি দুটি বাসে খবর দিই। তারা আমাদের আশুগঞ্জে উজান ভাটি রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করে। সেখানে পৌঁছে সিদ্ধান্ত হয়—আমাদের বাসটি সামনে থাকবে, আর বাকি দুইটি পাহারার মতো পেছনে। এ যেন কাফেলার মাঝে ঐক্যের বাস্তব প্রয়োগ!
ফজরের আলোয় সিলেটের পথে প্রত্যাবর্তন
হবিগঞ্জ জেলার সাতাইহাল জামে মসজিদে ফজরের নামাজ শেষে আবার যাত্রা। ক্লান্তি ছিল, তবে তৃপ্তি ছিল তার চেয়েও বেশি। অবশেষে নিরাপদে পৌঁছাই প্রিয় শহর সিলেটে।
শেষ কথাঃ
এই সফর কেবল একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ ছিল না। এটি ছিল বিশ্বাস, ঐতিহ্য, ভালোবাসা ও একতার এক অনন্য অভিযাত্রা। পথে পথে আলাপ, প্রতিটি ঘটনার বাঁকে শিক্ষা—এ সফর আমাদের মনে গেঁথে থাকবে বহুদিন। সায়্যিদ আহমদ শহীদ (রহ.)-এর আত্মত্যাগের স্মরণে গড়ে ওঠা এই মিলনমেলা যেন আমাদের আধ্যাত্মিক চেতনাকে আরেকবার নাড়িয়ে দিয়ে গেল।