নিজস্ব প্রতিবেদক, জকিগঞ্জ ::
২০ জুন, শুক্রবার দুপুর ২টা ৩০ মিনিট। নাম তার ‘আল্লাহ সহায়’। রুট সিলেট থেকে জকিগঞ্জ। নাম শুনে যে কেউ ভাবতে পারেন, যাত্রাটা নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ হবে। কিন্তু বাস্তবে এই গেইটলক বাসটি হয়ে ওঠে যাত্রীদের জন্য এক দুঃস্বপ্নের নাম। শুরু হয় এক অনিশ্চিত ও ভীতিকর যাত্রা—যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কা।
সিলেট শহর থেকে বাসটি ছাড়ার পর থেকেই চালকের বেপরোয়া আচরণে যাত্রীরা অস্থির হয়ে ওঠেন। গাড়ির গতি ছিল এতটাই দ্রুত, যেন এটি কোনো যাত্রীবাহী বাস নয়, বরং একটি রেসিং কার। এর মাঝেই যাত্রাপথে ‘সড়কের বাজার’ এলাকায় হঠাৎ এক বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো বাস। ভয় আর উৎকণ্ঠায় যাত্রীরা চালককে গতি কমাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তিনি ছিলেন নির্বিকার—উল্টো সামনে থাকা একটি বাসের সঙ্গে গতি প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েন।
আটগ্রাম স্টেশনে পৌঁছে এক সাহসী যাত্রী বাস থামিয়ে চাকার অবস্থা পরীক্ষা করেন। তিনি যা দেখলেন, তাতে তার শিউরে উঠলো শরীর। যে চাকায় থাকা উচিত আটটি নাট-বল্টু, সেখানে আছে মাত্র তিনটি। একটি চাকায় পর্যাপ্ত বাতাসও নেই। মোবাইলে ছবি তুলে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন—আর তা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়ে পড়ে।
বাসযাত্রী মাওলানা মো. শরীফ উদ্দিন বলেন,
“গাড়ির গতি দেখে মনে হচ্ছিল আমরা যেন মৃত্যু নামক এক গন্তব্যের দিকে ছুটে চলেছি। মানুষজন বাড়ী ছুটছে, আর আমরা বসে আছি মৃত্যুর সামনে! এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন চালকের হাতে আমরা কেন জীবন দেবো?”
এমন ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সিলেট-জকিগঞ্জ বাস মালিক সমিতির একজন প্রতিনিধি জানান,
“বিষয়টি খুবই দুঃখজনক ও লজ্জাজনক। ফিটনেসবিহীন বাস চলতে দেওয়া যায় না। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের প্রথম দায়িত্ব।”
সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার মাহবুব হাসান বলেন,
“প্রতিবছর শত শত প্রাণ হারায় আমাদের সড়কে, কারণ চালকদের অদক্ষতা ও গাড়ির অযোগ্যতা। ফিটনেস পরীক্ষার নামে কাগজে-কলমে যা হয়, তা বাস্তবে প্রহসন। এখনই যদি আমরা না জাগি, তাহলে এই মৃত্যুর মিছিল থামবে না।”
প্রতিটি যাত্রীই একজন সন্তানের মা, বাবার কাঁধে মাথা রাখা মেয়ে, কিংবা কোনো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এমন ঝুঁকিপূর্ণ বাস রাস্তায় চলাচল করছে অথচ কেউ দেখছে না, জানছে না—এ দায় কার?
উল্লেখ্য, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই জকিগঞ্জ উপজেলায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৯ জন। এ সংখ্যার পেছনে রয়েছে ৯টি পরিবার, যাদের জীবনে ঈদের আনন্দ নেই—আছে কেবল শোক আর অশ্রু।
এখনই যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কঠোর ব্যবস্থা না নেয়, যদি ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোর লাইসেন্স বাতিল না করা হয়, তবে “একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না” কেবল স্লোগানই থাকবে না—এটি হয়ে উঠবে বহু পরিবারের নিরব চিৎকার।
জননিরাপত্তা এখন কেবল আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়—এটি একটি মানবিক দায়। তাই প্রশ্ন রয়ে যায়, আর কত প্রাণ ঝরলে আমরা জাগবো?