ছক্কা ছয়ফুর: সিলেটের জনমানুষের রাজনীতির এক কিংবদন্তি নাম



বাবুর্চি থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান—এক সাধারণ মানুষের অসাধারণ যাত্রা

তাঁর নাম ছয়ফুর রহমান। পেশায় ছিলেন বাবুর্চি—একেবারেই গ্রাম্য, সালুটিকর বাজারের পাশের এক ছাপড়া ঘরে দিন আনি দিন খাই জীবন। নামিদামি রাঁধুনি ছিলেন না, কিন্তু ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব—সরল, রসিক, আর সমাজসচেতন।

যেকোনো সামাজিক অন্যায় বা অবিচার দেখলে তিনি চুপ থাকতেন না। ধরুন, সালুটিকর থেকে শহরে আসার বাসভাড়া আট আনা বেড়ে গেল—ব্যস, বিকেলে কোর্ট পয়েন্টে মাইক বেঁধে প্রতিবাদ সভা করবেনই করবেন।

ছড়ার সুরে বক্তৃতা, শেষে মাইকের খরচ তোলা

অসাধারণ রসবোধের মানুষ ছিলেন ছয়ফুর রহমান। বক্তৃতায় ছড়ার ছোঁয়া, কথায় তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ—তাঁর মুখে রাজনীতি হয়ে উঠত জনতার ভাষা। বক্তৃতা শেষে হাসিমুখে কাপড় বিছিয়ে বলতেন, “আমি এই যে আপনাদের জন্য আন্দোলন করতেছি, আমার মাইকের খরচ দিবে কে? মাইকের খরচ দেন।”

অদ্ভুত ব্যাপার—দর্শকদের কাছ থেকে টাকা তুলতে কখনো দেরি হতো না। দুই টাকা, এক টাকা করে তাঁর কাপড়টি ভরে উঠত। তিনশ টাকা হলেই বলতেন, “হইছে, মাইকের খরচ উঠছে।”

‘বাবুর্চি প্রেসিডেন্ট হতে চায়’

বক্তৃতার পাশাপাশি লিখতেন বইও। চটি আকারের কয়েকটি বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল ‘বাবুর্চি প্রেসিডেন্ট হতে চায়’। বইটির পেছনে তাঁর মুখ বিকৃত করা এক সাদাকালো ছবি, নিচে লেখা— “দুর্নীতিবাজদের দেখলেই এরকম ভ্যাংচি দিতে হবে।”

নিজের রাজনৈতিক দলও ছিল তাঁর—‘ইসলামি সমাজতান্ত্রিক দল’। কিন্তু সদস্য হিসেবে কাউকেই নিতেন না। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, “একের বেশি লোক হলেই দল দুইভাগ হয়ে যাবে।”

নির্বাচনে ‘ছক্কা’ পেটানো মানুষ

তিনি একাধিকবার নির্বাচন করেছেন, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তাঁকে মজার প্রার্থী হিসেবেই দেখেছিল। কিন্তু ১৯৯০ সালের উপজেলা নির্বাচনে ঘটে গেল অভাবনীয় ঘটনা—সিলেট সদর উপজেলায় তিনি নির্বাচিত চেয়ারম্যান!

তাঁর প্রতীক ছিল ডাব। হাতে হ্যান্ডমাইক, মুখে তীক্ষ্ণ রসবোধের বক্তৃতা—এই ছিল তাঁর প্রচারণা। পোস্টার বা লিফলেট কিছুই ছিল না। এক প্রার্থী পক্ষের হামলার ঘটনায় সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। স্কুল-কলেজের ছাত্ররা রাস্তায় নামে প্রতিবাদে। ফলাফল—ডাব প্রতীকে ছয়ফুর রহমান পেলেন ৫২ হাজার ভোট, আওয়ামী লীগ প্রার্থী পেলেন ৩০ হাজার।

দক্ষিণ সুরমার এক কেন্দ্রে তাঁর ১৮০০ ভোট, আর দ্বিতীয় প্রার্থী পেয়েছেন মাত্র ১ ভোট!

এরপর থেকেই তিনি পরিচিত হন ‘ছক্কা ছয়ফুর’ নামে। তিনি হেসে বলেছিলেন, “নির্বাচনে ছক্কা পিটানোয় মানুষ এই নাম দিছে।”

প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি অগাধ ভালোবাসা

উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে ছক্কা ছয়ফুরের মূল ফোকাস ছিল প্রাথমিক শিক্ষা। হুটহাট যেকোনো প্রাইমারি স্কুলে ঢুকে পড়তেন। শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে সঙ্গে সঙ্গে শোকজ করতেন। তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো অনেকটাই উপজেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

তবে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কারণে অনেকের বিরাগভাজন হন তিনি। চেয়ারম্যানদের অনাস্থা প্রস্তাবের পর শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয় তাঁর পদ স্থগিত করে। উপজেলা পরিষদ বিলুপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায় ছক্কা ছয়ফুরের রাজনৈতিক অধ্যায়ও।

বারান্দায় অনশন, জীবনের শেষ লড়াই

জীবনের শেষদিকে এই অকৃত্রিম মানুষটি চিকিৎসা খরচের দাবিতে সিলেট ডিসি অফিসের বারান্দায় অনশন করেছিলেন—এবং দাবিও আদায় করেছিলেন। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে, হাসিমুখে, তিনি এই পৃথিবী ছেড়ে গেছেন।

সমাপ্তি

আজও ছক্কা ছয়ফুরের গল্প সিলেটের চায়ের আড্ডায়, রাজনীতির আলোচনায়, কিংবা জনসভায় স্মরণ করা হয় এক অমলিন হাসি নিয়ে। তিনি ছিলেন রাজনীতির রসিক মুখ, আবার জনমানুষের আন্তরিক মুখও।

সরলপ্রাণ এই সমাজবিপ্লবীর প্রতি সাপ্তাহিক সবুজ প্রান্তের বিনম্র শ্রদ্ধা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতরপূর্বতন