দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য ধারণকারী নিদর্শনগুলো আমাদের জাতিসত্তার পরিচায়ক। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও স্থাপত্যিক দৃষ্টিকোণ থেকে এসব স্থান কেবল দর্শনীয়ই নয়, বরং আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে নতুন আলো ছড়িয়ে দেয়। এ রকমই এক আত্মিক উপলব্ধির অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা পৌঁছাই চট্টগ্রামের একটি বিশেষ ধর্মীয় স্থাপনায়—কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
২০২৫ সালের ২ মে, শুক্রবার। চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্যের একটি অংশ স্বচক্ষে দেখার আগ্রহ নিয়ে আমরা সিলেট থেকে চট্টগ্রামের পথে যাত্রা করি। সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল চট্টগ্রামের পুরনো স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম ও আধ্যাত্মিক মর্যাদাসম্পন্ন "কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ" পরিদর্শন।
দুপুর প্রায় ১২টার দিকে আমরা সিএনজিযোগে মসজিদ কমপ্লেক্সে পৌঁছি। নামাজের প্রস্তুতি নিতে নিতে চোখে পড়ে মসজিদের চারপাশের নিস্তব্ধ, কিন্তু গভীর অর্থবহ পরিবেশ। প্রাচীন এক আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য যেন ঘিরে রেখেছে পুরো চত্বর। জুমার জামাতের আগে মুসল্লিরা ধীরে ধীরে জমায়েত হচ্ছিলেন, আর আমরা ঘুরে দেখছিলাম ঐতিহাসিক এই মসজিদ ও তার বিশেষ আকর্ষণ—পবিত্র পদচিহ্নদ্বয়।
এই মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এখানে সংরক্ষিত দুটি পদচিহ্ন—একটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এবং অপরটি সুফি সাধক বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.)-এর। মসজিদের উত্তর প্রান্তে সুরক্ষিত কাচের আলমারিতে সংরক্ষিত এই পদচিহ্নদ্বয় বহু যুগ ধরেই ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য গম্ভীর শ্রদ্ধা ও ভক্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।
আমরা যখন সেখানে পৌঁছাই, তখনও কিছু মানুষ শ্রদ্ধাভরে পদচিহ্নের সামনে দোয়া করছিলেন। কেউ সযত্নে স্পর্শ করছেন, কেউবা আবেগ ধরে রাখতে না পেরে চুম্বন করছেন পদচিহ্নের কাঁচ। ধৌতকৃত পানি পান করে আত্মিক আশীর্বাদ লাভের আশাও ছিল অনেকের মধ্যে। এসব দৃশ্য আমাদের মনকে অভিভূত করে, যেন কোনো আধ্যাত্মিক মহাশক্তি ভর করেছে মুহূর্তটির উপর।
জুমার খুতবায় খতীব মাওলানা মোহাম্মদ বদিউল আলম রেজভী আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস উপলক্ষে এক অনন্য বক্তব্য রাখেন। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রমের মর্যাদা, অধিকার এবং নবীদের শ্রমের বাস্তব উদাহরণ তুলে ধরে তিনি শ্রমিক শ্রেণির প্রতি সম্মান এবং দায়িত্বশীল মনোভাব গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বিশেষ করে আদম (আ.) থেকে শুরু করে নবী মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সব নবীর জীবনে শ্রম ও আত্মনির্ভরতার অনুশীলন যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তা সুন্দরভাবে তুলে ধরেন। খুতবার শেষাংশে গাজীপুরে ইমাম মাও. রঈস উদ্দিন হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি সরকারের কাছে বিচারের জোর দাবি জানান।
তবে নামাজ শুরু হলে একটি বিষয় আমাদের কিছুটা ভাবিয়ে তোলে—আর তা হলো খতীব সাহেবের ক্বিরাত। একজন অভিজ্ঞ আলেম হয়েও তাঁর তিলাওয়াতে শুদ্ধতার অভাব ছিল লক্ষণীয়। আমরা তখন গভীরভাবে অনুভব করি বিশ্ববরণ্য কুরআনের পাখি, রঈসুল কুররা শামসুল উলামা হযরত আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (রহ.)-এর অবদান, যিনি পবিত্র মক্কা শরীফ থেকে বিশুদ্ধ কিরাতের সনদ নিয়ে এসে এদেশের মুসলমানদের মধ্যে কিরাতের বিশুদ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজ তাঁরই চেষ্টায় বৃহত্তর সিলেটের একজন সাধারণ মুসলমানও কিরাত পাঠে শুদ্ধতা বজায় রাখেন।
স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও কদম মোবারক মসজিদ অনন্য। মোঘল ফৌজদার মুহাম্মদ ইয়াসিন খান ১৭২৩ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। কথিত আছে, তিনি হিজাজ থেকে মহানবীর পদচিহ্নসংবলিত পাথর সংগ্রহ করে দেশে আনেন এবং সেগুলো এই মসজিদে সংরক্ষণ করেন। আয়তাকার ছাদযুক্ত এ মসজিদটিতে রয়েছে তিনটি গম্বুজ, চারটি সুসজ্জিত মিনার, মোঘল আমলের অপূর্ব আরবি ক্যালিওগ্রাফি, জ্যামিতিক অলঙ্করণ এবং দৃষ্টিনন্দন মোজাইক কারুকাজ।
মসজিদ কমপ্লেক্স ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে কবরস্থান, মাদ্রাসা, এতিমখানা, একটি উচ্চ বিদ্যালয় ও একটি মিলনায়তন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো এখানকার এতিমখানাটি, যা প্রতিষ্ঠা করেন চট্টগ্রামের প্রখ্যাত চিন্তাবিদ মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। এটি বর্তমানে চট্টগ্রামের অন্যতম বৃহৎ মুসলিম এতিমখানা হিসেবে পরিচিত।
এই ভ্রমণ আমাদের জন্য ছিল কেবল একটি স্থান দর্শনের অভিজ্ঞতা নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছিল আত্মিক, ঐতিহাসিক এবং মানবিক চেতনায় সমৃদ্ধ এক শিক্ষামূলক দিন। কদম মোবারক মসজিদের পরিমিত সৌন্দর্য, আধ্যাত্মিক আবহ এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য আজও নিঃশব্দে বর্ণনা করে চলে চট্টগ্রামের গভীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।
[বি.দ্র : পুরো সফরে আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন সিলেট আল-কুরআন মেমোরাইজিং সেন্টারের প্রিন্সিপাল মাওলানা ইমরান উদ্দিন চৌধুরী। আমাদের সাথে আরো ছিলেন জকিগঞ্জ সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার সহকারি অধ্যাপক মাওলানা ইমাদ উদ্দিন গুটারগ্রামী, জকিগঞ্জ লেখক পরিষদের সহ-সভাপতি মাওলানা ফদ্বলুর রহমান, ছড়াকার কায়েস মাহমুদ চৌধুরী, মাও. শহীদ উদ্দিন রাজু, ব্যবসায়ী ফারুক আহমদ সহ আরো কয়েকজন।]