বিশ্বনাথ-ওসমানীনগরের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক প্রতিযোগিতা ও বাস্তব ভাবনা


ড. মোঃ রইছ উদ্দিন

কিছুদিন ধরে আমার নির্বাচনী এলাকা বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর থেকে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে এক ধরনের অসম প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ প্রতিযোগিতা কখনো কখনো বিতর্ক ও সংঘাতে রূপ নিচ্ছে। গতকালই তার সামান্য প্রকাশ ঘটেছে—যা ভবিষ্যতে আরও তীব্র হয়ে প্রাণহানির আশঙ্কা তৈরি করতে পারে।
বিবেকের তাড়নায়, আমি এ প্রেক্ষাপটে কিছু বাস্তবধর্মী মূল্যায়ন ও প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা প্রয়োজন মনে করছি।

ইলিয়াস আলী—একজন নেতা থেকে জনগণের অনুভূতি

বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ একসময় ছিল আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত বিএনপির ভোট সংখ্যা ছিল মাত্র দশ-বারো হাজার। আমাদের প্রয়াত জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল হক চাচা এই আসন থেকে ওই পরিমাণ ভোটই পেয়েছিলেন।
সে সময় ইলিয়াস ভাই ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা, আমি তখন সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি।
ইলিয়াস ভাই এলাকার দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করলেন—বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। আমি তাঁর সঙ্গে এমন সব দুর্গম এলাকায় গেছি, যেখানে রাস্তা-ঘাট ছিল না; কাদা-মাটি পেরিয়ে, নৌকা ভ্রমণ করে, কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা হেঁটে গেছি। দিন-রাত, আহার-নিদ্রার তোয়াক্কা না করে তিনি মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন।

একজন ইলিয়াস আলীর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলেই আওয়ামী লীগের দুর্গ বিএনপির ঘাঁটিতে রূপ নেয়।
তিনি শুধু একজন এমপি ছিলেন না; ছিলেন মানুষের নয়নের মণি। এমপি হওয়ার পর তিনি এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা ও উন্নয়নে যে পরিবর্তন এনেছিলেন, তা আজও দৃশ্যমান। অনেকে বলেন—“এখন এত রাস্তা হয়েছে যে, পথে হারিয়ে যাই।”

গুম হওয়া এক নেতার অমর উত্তরাধিকার

পরে ইলিয়াস আলী হয়ে উঠলেন সিলেট বিএনপির কান্ডারী ও জাতীয় নেতা। দেশের স্বার্থে, সিলেটবাসীর স্বার্থে, টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বিদেশি ও দেশি চক্রান্তের শিকার হন।

তারপর থেকে তিনি নিখোঁজ—আমরা আজও জানি না, তিনি বেঁচে আছেন কি না। তাঁর অনুপস্থিতিতে, তাঁর সহধর্মিণী তাহসিনা রুশদীর লুনা ভাবী অগণিত প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে এলাকার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন।
এলাকার কল্যাণে তিনি এমনকি নিজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটিও ত্যাগ করেছেন—যা নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে কিছু বাস্তব প্রস্তাবনা

১️ ইলিয়াস আলী শুধু একজন এমপি নন, তিনি এ এলাকার মানুষের আবেগ, অনুভূতি ও ভালোবাসার নাম। তাঁর আত্মত্যাগ কেবল এই এলাকার নয়, গোটা জাতির সম্পদ। তাঁকে উপেক্ষা করা মানে সিলেট নয়, গোটা দেশে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি করা। এ বিষয়ে বিএনপির হাইকমান্ডের গভীর চিন্তা প্রয়োজন।

২️হুমায়ুন কবির—যতদূর শুনেছি, তিনি একজন শিক্ষিত ও গুণী মানুষ, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কাজ করেন। এ আসনের একজন সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে তিনি এমপি হওয়ার চিন্তা করতে পারেন, কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় তিনি যদি ইলিয়াস আলীর ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করেন, তবে তাঁর জন্য তা সম্মান ও ভবিষ্যৎ সুযোগের দরজা উন্মুক্ত করবে।

৩️কিছু তিক্ত বাস্তবতা উল্লেখ করা প্রয়োজন।
ইলিয়াস ভাই জীবিত থাকাকালে তিনি প্রত্যেক কার্যকর ব্যক্তিকে কৌশলে কাছে টেনেছিলেন। আজ তাদের অনেককেই ভিন্ন অবস্থানে দেখা যায়।

আমিও রাজনীতিতে জড়াতে চাই না—আমার এখনো প্রায় বারো বছর চাকরির সময় বাকি আছে। তবু লক্ষ্য করছি, কিছু মানুষ আমাকে নিয়েও নানা মন্তব্য করছেন—তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলি, রাজনীতি নয়, পেশাই আমার অঙ্গীকার।

যারা আজ দূরে সরে গেছেন, একসময় তারাই ছিলেন ইলিয়াস ভাইয়ের ঘনিষ্ঠজন। তাদের অবদানও অস্বীকার করা যায় না। সম্ভবত কিছু ভুল বোঝাবুঝি বা বিভাজন সৃষ্টিকারী তৃতীয় পক্ষের ভূমিকা এর পেছনে কাজ করেছে।

সমাধান: সংলাপ ও ঐক্যই একমাত্র পথ

বিএনপি একটি বৃহৎ ও গণতান্ত্রিক দল। সামনের জাতীয় নির্বাচন কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং হবে। এ অবস্থায় পারস্পরিক যোগাযোগ বৃদ্ধি, খোলামেলা আলোচনা, এবং দলীয় ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা এখন সময়ের দাবি।

লুনা ভাবীর প্রতি আমার অনুরোধ—
আপনি ইলিয়াস আলীর প্রতিনিধি। যেভাবে ভাই সবাইকে নিয়ে কাজ করেছেন, আপনিও সবাইকে নিয়ে চলুন। আপনি ডাকলে কেউ অভিমান করবে না। সবার ত্যাগকে মূল্যায়ন করুন, ভালোবাসা দিন, ঐক্যের ডাক দিন।
আমার বিশ্বাস—এই আঁধার কেটে যাবে, ইনশাআল্লাহ।

লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতরপূর্বতন