ফুলতলী এতিমখানা থেকে ডাকসু নির্বাচনে—আব্দুল বাছিতের সংগ্রামী পথচলা

একটা শৈশব কেটে গেছে বাবা-মা ছাড়া। মমতার স্পর্শ, স্নেহের হাত কিংবা পরিবারের ভালোবাসা ছুঁয়েও দেখেননি তিনি। জীবনের প্রথম পাঠ শিখেছেন সিলেটের জকিগঞ্জের ফুলতলী ছাহেব বাড়ীতে অবস্থিত দেশের অন্যতম বৃহৎ লতিফিয়া এতিমখানায়। এতিমখানার ছোট্ট এক কক্ষে বসে জীবনের মানে খুঁজতে খুঁজতেই বড় হয়ে ওঠা সেই ছেলেটিই আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। তার নাম—আব্দুল বাছিত

তিনি বলেন, “বাধ্য হয়েই এতিমখানায় যেতে হয়েছিল। সেখান থেকেই জীবনের সংগ্রাম শুরু, যা হয়তো মৃত্যু পর্যন্ত চলবে। বাবা-মা ছাড়া জীবন কেমন হয়, তা আমার মতো করে আর কে জানে?”

বাবাময় স্মৃতি বড় ছাহেবকে ঘিরে

আব্দুল বাছিত জানান, তার যখন মন খারাপ থাকে তখন তিনি চোখ বুজে একটি দৃশ্য কল্পনা করেন। “মনে হয়, আমি আবার এতিমখানায় আছি। বড় ছাহেব (মা.জি.আ) আমাদের ডেকেছেন গোসল করানোর জন্য। সারির সবার আগে আমি থাকায় আমার হাত ধরে সবাইকে নিয়ে পুকুরে নামলেন। আমাদের সঙ্গে তিনি নিজেও গোসল করলেন। কিছুক্ষণ পর নিজ হাতে আমার গায়ে সাবান মেখে দিলেন। তারপর আবার পুকুরে ডুব দিলাম। মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে যায়। আমার আব্বার সঙ্গে কোনো স্মৃতি নেই, কারণ তিনি মারা গেছেন আমার দেড় বছর বয়সে। বাবাময় যত স্মৃতি সব বড় ছাহেবকে ঘিরেই।”

কথাগুলো বলতে বলতে আব্দুল বাছিতের চোখে যেন শৈশব ফিরে আসে। তিনি হাসিমুখে বলেন, “এই তো মন ভালো হয়ে গেল! একটু আগেও মন খারাপ ছিল, এসব কল্পনা করে এখন আমি ফুরফুরে মনে লিখছি।”

তার ভাষায়, “বড় ছাহেবকে চিনেছেন? উনার নাম আল্লামা ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী (মা.জি.আ)। আমার মতো হাজার হাজার এতিমের বাবার স্বপ্ন যিনি পূরণ করে যাচ্ছেন।”

মানুষের জন্য বাঁচার অঙ্গীকার

২০২২ সালের সিলেটের ভয়াবহ বন্যায় কিংবা ২০২৪ সালে ফেনীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। উত্তরবঙ্গের হাড় কাঁপানো শীতে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন, পথশিশুদের হাতে খাবার ও পোশাক তুলে দিয়েছেন। নিজের মতো এতিম শিশুদের আর্থিক ও মানসিক সাপোর্ট দিয়েছেন।

শুধু তাই নয়, তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন শিক্ষার্থীদের কল্যাণে ‘ইনিশিয়েটিভ ফর স্টুডেন্টস’ নামের একটি সংগঠন, যেখানে আর্থিকভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীরা সাহায্য পায়। পাশাপাশি আরও কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গেও তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত।

সংগ্রামের ময়দানেও সোচ্চার

অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় সরব থেকেছেন বাছিত। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটা সংস্কার কিংবা মানবাধিকার কমিশনের সামনে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য দাবিতে তার উপস্থিতি ছিল অনন্য। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণে একসময় ছাত্রলীগ তাকে মারধর করে হল থেকে বের করে দেয়। কিন্তু থেমে যাননি।

তিনি বিশ্বাস করেন, “টাকা-পয়সা কিংবা ক্ষমতা নয়, বিনয়ই মানুষের হৃদয় জয় করার একমাত্র হাতিয়ার। ছোটদের স্নেহ আর বড়দের সম্মান করার শিক্ষা আমি এতিমখানায় পেয়েছিলাম, আজও সেই পাঠ আঁকড়ে ধরে আছি।”

ডাকসু নির্বাচনে নতুন যাত্রা

আগামী ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য ডাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিচ্ছেন আব্দুল বাছিত। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন তিনি। শিক্ষার্থীদের কল্যাণ ও ন্যায়ভিত্তিক ক্যাম্পাস গড়ার স্বপ্নই তার একমাত্র লক্ষ্য।

তার কণ্ঠে দৃঢ় প্রত্যয়— “ডাকসুকে আমি সম্ভাবনা হিসেবে দেখছি। এখানে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করার সুযোগ পাবো। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত মানুষের জন্য কাজ করাই আমার অঙ্গীকার।”

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতরপূর্বতন